সাদিক উল ইসলাম :
উত্তরবঙ্গ মঙ্গা ও দারিদ্র্য কবলিত এলাকা হিসেবে বেশ পরিচিত। এর মধ্যে নীলফামারী জেলা অন্যতম। এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ একসময় দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করতো। জীবিকার তাগিদে এলাকার কর্মঠ মানুষেরা অনেকেই ঢাকামুখী হতো। নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নে কেউ কেউ আবার বিদেশেও পাড়ি জমাতো। উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী জেলা নীলফামারী দীর্ঘ দিন ধরে অবহেলিত ও যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ছিল । ফলে এই অঞ্চলের বসবাসকারীরা এক সময় চরম কষ্টে দিন কাটাতো। তবে, সময়ের সাথে সাথে নীলফামারীবাসীর সুদিন ফিরেছে দুঃখ কষ্ট হয়েছে লঘব। আর তা সম্ভব হয়েছে “উত্তরা ইপিজেডের” কল্যাণে।
২০০১ সালের জুলাই মাসে মঙ্গা পীড়িত জেলা নীলফামারী সদর উপজেলার সংগলশি ইউনিয়নে ২১৩ একর জমির উপর তৈরী হয় উত্তরা ইপিজেড। ইপিজেডে বাণিজ্যিক প্লট রয়েছে ১৮৭ টি তার মধ্যে ১৩৮টি প্লট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ইপিজেডে বর্তমানে এভারগ্রীন প্রোডাক্টস ফ্যাক্টরী, ওয়েসিস ট্রান্সফরমেশন লিমিটেড, ম্যাজেন ইন্ডাস্ট্রিজ, ভেনচুরা লেদার ম্যানুফ্যাকচারিং, সেকশন সেভেন ইন্টারন্যাশনাল, কোয়েস্ট এক্সেসরিজ, কেপি ইন্টারন্যাশনাল, এস এ ইন্টারন্যাশনাল, ফারদিন এ্যাক্সেসরিজ, সনিক বাংলাদেশ, ডং জিন ইন্ডাস্ট্রিজ, উত্তরা সোয়েটার ম্যানুফ্যাকচারিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা রকম পণ্য সামগ্রী উৎপাদন করে চলেছে।
প্রতিষ্ঠার পর ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত নীলফামারীর উত্তরা ইপিজেডের কারখানাগুলো থেকে রফতানি হয়েছে ৯৯ কোটি ৫৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৯৯৫.৬৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) সমমূল্যের নানা পণ্য। এই রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলকে ঘিরে আশেপাশের এলাকায় গড়ে ওঠেছে দেশি-বিদেশি আরও ২০টি কারখানা। হাজার হাজার কর্মহীন মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়েছে। এরমধ্যে ৬৫ শতাংশই নারী, যা নারীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিশাল অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও কারখানাগুলোর কাঁচামাল সরবরাহকে কেন্দ্র করে বড় বড় বাজার গড়ে উঠেছে। উত্তরা ইপিজেড প্রতি মাসে ৩০মিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এর রফতানির পরিমাণ এক হাজার ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখানে কর্মরত শ্রমিকরা প্রতি মাসে ৪০ কোটি টাকা আয় করে। উত্তরা ইপিজেড এর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ মঙ্গাপীড়িত এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। দূর করেছে বেকারত্বের অভিশাপকে। এই অঞ্চলের মানুষের অর্থনীতিকভাবে মুক্তির পথ প্রশস্থ করে দেওয়ায় ভূমিকা রেখেছে, সময়ের সাথে সাথে উত্তরবঙ্গের আশার আলোতে পরিণত হয়েছে ইপিজেডটি।
বাংলাদেশ ইপিজেড কর্তৃপক্ষ (বেপজা) জানায়, উত্তরা ইপিজেডে বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এখানে উদ্যোক্তাদের জন্য শিল্প প্লট ও কারখানা ভবনের ভাড়া ৫০ ভাগ কমানো হয়েছে।এই শিল্পাঞ্চলে বছরে ১ স্কয়ার মিটারের জন্য মাত্র ১ ডলার ভাড়া দিতে হয়, যা দেশের অন্যান্য ইপিজেডের তুলনায় অনেক কম। দেশের একমাত্র কৃষিভিত্তিক উত্তরা ইপিজেড স্থাপনে ব্যয় হয়েছে আনুমানিক ৫৩ কোটি টাকা। এই ইপিজেড থেকে বছরে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করা হয়। ইপিজেড পাল্টে দিয়েছে জেলার মানুষের জীবিকার চিত্র। ইপিজেড উত্তরবঙ্গের মানুষের আশা- আকাঙ্খা পূরণের কান্ডারী হিসেবে পরিণত হয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
নীলফামারী সদরের সংগলশী ইউনিয়নের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, আমাদের এই এলাকার মানুষ কয়েক বছর আগেও ছিল মঙ্গায় জর্জরিত। ইপিজেড চালু হওয়ার পর প্রতিটি বাড়ি থেকে এক থেকে তিনজন নারী-পুরুষ এখানে কাজ করছে। আগে যাদের ভাঙ্গাচোরা বাড়ি-ঘর ছিল, তারাই আজ পাকা বাড়ি বানিয়েছেন। এই এলাকায় এখন ক্ষেতে-খামারে কাজ করার মতো শ্রমিক পাওয়া খুব কঠিন । এবং”
ইপিজেড কর্মী পারভিন বেগম বলেন, আমরা এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ ইপিজেডে কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। আগে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরাতো অবস্থা। পেট ভরে একবেলা খেতে পেতাম না। এখন দশ হাজার টাকা বেতন পাই। সংসার এখন ভালোই চলছেএখন আমাদের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। দীর্ঘ দিন দুঃখ দুর্দশায় জর্জরিত থাকার পর এখন আমরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি এবং তা বাস্তব হচ্ছে ।
এখনো এ অঞ্চলের মানুষের নানা স্বপ্ন ও চাওয়া পাওয়া ঘিরে রয়েছে উত্তরা ইপিজেড । শুধু সাধারণ মানুষের নয় রয়েছে কর্তৃপক্ষেরও । উত্তরা ইপিজেড নীলফামারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে চলেছে। সেইসঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই ইপিজেডে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত, ইপিজেড থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকমানের করা হলে এবং ৩৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের হলদিবাড়ির সঙ্গে চিলাহাটি সরাসরি রেল যোগাযোগ ও স্থলবন্দর চালু হলে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে ইপিজেডটির বিনিয়োগকারীর সংখ্যা আরও বাড়বে এবং দেশের সেরা ইপিজেড হিসেবে উত্তরা ইপিজেড প্রতিষ্ঠিত হতে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন শিল্প উদ্যোক্তা ও ইপিজেড কর্তৃপক্ষ।