শিক্ষাজব ডেস্ক:
যে ওষুধটা নিত্যদিন লাগে তার দাম দ্বিগুণেরও বেশি এখন। রিকশাভাড়াও তাই। বাসভাড়া সরকারিভাবে ৬০ শতাংশ বাড়লেও রোজগারহীন মানুষকে দিতে হয় তার চেয়েও বেশি। বেশি বেশি হাত ধুতে হবে, মাস্ক লাগবে, স্যানিটাইজার লাগবে- সব বাড়তি খরচের ধাক্কা। করোনাকালে মধ্যবিত্তের এমন করুণ হাল নিয়ে অনেক কথাই বলা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে, কখনও কখনও টেলিভিশন টকশোতে, পত্রিকার প্রথম পাতায়।
মধ্যবিত্তের কী হবে, কী হচ্ছে তা নিয়ে কথা উঠছে ঠিকই, তবে একথাওতো সত্য যে মধ্যবিত্তের কথা মধ্যবিত্ত ছাড়া আর কেউ নেই শোনার। একসময় সরকারি কর্মকতা-কর্মচারীরা মধ্যবিত্তের শ্রেণিতেই অবস্থান করত। এখন তারা উচ্চবিত্ত। গত দশ বছরে সরকারি তাদের বেতনই কেবল বেড়েছে ২২১ শতাংশ। অন্যান্য সুবিধাতো আছেই। এই করোনাকালেও তাদের প্রণোদনা ঈর্ষণীয়। আক্রান্ত হলে বা মৃত্যুবরণ করলে যে ক্ষতিপূরণ তারা বা তাদের পরিবার পাচ্ছে সেটা একজন বেসরকারি উচ্চপদের কর্মী বা ছোট সাধারণ ব্যবসায়ীর সারাজীবনের আয়ও নয়। সব সরকারি কর্মচারী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, কিন্তু রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের বিভাজন বিশাল, তাই তাদের সুবিধার পাহাড় কেবল বাড়ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএস বলছে করোনার কারণে মানুষের আয় কমে গেছে, বেড়েছে বেকারত্ব। যাদের আয় কম, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের আয়ের উৎস একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়ক সেন বলেছেন, করোনার কারণে গত চার মাসে যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন তাদের আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি তেমন কাজে আসবে না। কারণ বাংলাদেশে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির কোনো টার্গেট গ্রুপ নেই। আমরা জানি, থাকলও সেটা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে।
এগুলো সবই মধ্যবিত্তের দুঃখকথা। কিন্তু জীবনতো কেবল পরিসংখ্যান নয়। করোনাকাল এক নতুন বাস্তবতা নিয়ে মধ্যবিত্তের সামনে। বাঁচার জন্য খাদ্য চাই, সন্তানের শিক্ষা চাই, নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষা চাই। কিন্তু এই মধ্যবিত্ত এখন ভাবছে অন্য কিছু। সে বারবার বুঝতে চায় সে করোনায় মরবে না খিদেয়?
ভাবতে কষ্ট হচ্ছে? কিংবা ভাবতে পারছি না? বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে চাকরিজীবী মধ্যবিত্তের বেশিরভাগেরই প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, গ্র্যাচুইটি নেই। যা আছে সেটা হলো তার ক্ষুদ্র সঞ্চয়। করোনা সেটিও নিঃশ্বেষ করে এনেছে। যাদের বাড়ি আছে তাদের একটা বড় অংশ খুব সাধারণ জীবনযাপন করে ভাড়ায় আয় দিয়ে। বাড়িওয়ালাদের সবাই উচ্চবিত্ত নয়। ভাড়াটিয়ারা ভাড়া দিতে পারছে না, বাড়ি ছাড়ছে, টু-লেটের সাইনবোর্ড বাড়ছে আর এমন নির্ধারিত আয়ের মানুষের অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
নাগরিক সমাজে মধ্যবিত্ত বৃত্তিজীবী বাঙালি উকিল, ডাক্তার, কবি-লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপকের নাম হারাতে শুরু করেছে আগে থেকেই। এখন করোনার দাপটে সেটি আরও দ্রুততর হচ্ছে। এ শহরের সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ এখন শুধু রাজনীতিক, আমলা ও ক্ষমতার কেন্দ্রে সখ্য রাখা ব্যবসায়ীর।
খরচ বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। আর কিন্তু আয় কমছে। মধ্যবিত্ত আজ নিঃস্ব, বিপন্ন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মরতদের অনেকে বেতন পাচ্ছেন না। জমানো অর্থ শেষে হয়ে আসছে। সময় কাটে চাকরি হারানোর শঙ্কায়৷ সরকারের কোনো প্রণোদনার মধ্যে নেই তারা। ফলে চলমান মহামারির মহামন্দায় মহাসংকটে পড়েছে বাংলাদেশে কয়েক কোটি মধ্যবিত্ত। এখন তারা নগর ছাড়ছে। পত্র-পত্রিকা বলছে, করোনার অভিঘাতে টিকতে না পেরে ঢাকা ছেড়ে গেছেন ৫০ হাজার মানুষ।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে অর্থনীতি যে দ্রুত গতিতে এগুচ্ছিল তা যেন থমকে গেল এক ধাক্কায়। বিশাল প্রবৃদ্ধি নিয়ে চলা দেশ বাংলাদেশের প্রধান চালিকাশক্তি এই মধ্যবিত্ত। কিন্তু গ্রামেও কি কাজ আছে? আমরা জানি সবসময়ই শহরের বাসিন্দাদের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দারিদ্র্যসীমার নিচে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। শহরের মানুষদের তুলনায় গ্রামীণ এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠার সম্ভাবনা কম এবং সীমার নিচে নেমে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এখন সেই গ্রামেই ফিরছে শহরে থাকতে না পারা মানুষ।
মধ্যবিত্ত যদি এভাবে হারিয়ে যায় তাহলে হারায় কী? হারায় আদর্শ জীবনবোধ। শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতির সৃজনশীল ভুবনে তারাই সক্রিয়। মোটামুটি খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মধ্যেই তারা সততা ও মূল্যবোধের ধারক-বাহক। মধ্যবিত্তরা লেখালেখি করে, তারাই সঙ্গীতের আসর, নাটকপাড়া, সিনেমা আর বইমেলা বাঁচিয়ে রাখে। ঈদের সময় পত্রিকার ঈদ সংখ্যা তাদেরই জন্য। যেটুকু সুস্থ রাজনীতি এখনও অবশিষ্ট সেটুকুতেও মধ্যবিত্তেরই মুখ। মধ্যবিত্তের উপরেই বিশ্বাস ও ভরসা। তারা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন সৃজন করেন।
মধ্যবিত্তের নিজস্বতা, মধ্যবিত্ত মানস আমাদের রুচি নির্মাণ করে। সেই মধ্যবিত্তের একটা অংশ উপরে উচ্চবিত্তে ধাবমান হলে কিছু রুচি নিয়ে যায় সাথে করে। কিন্তু যদি তার নিম্নবিত্তায়ন হয়, যদি মধ্যবিত্তের প্রান্তিকায়ন ত্বরান্বিত হয়, যদি মধ্যবিত্তদেরই মানবিক মুখটা সমাজ থেকে হারিয়ে যায় তাহলে নতুন এক আর্থ-সামাজিক পরিবর্তন হয়তো অচিরেই দেখব আমরা।
লেখক : সম্পাদক, জিটিভি।
সূত্র: জাগো নিউজ